স্ত্রী মশারাই মানুষকে কামড়ায়

অধ্যাপক ড. মো: গোলাম ছারোয়ার|

স্ত্রী মশারাই মানুষকে কামড়ায় রক্ত হতে খাবার সংগ্রহ করতে। মানুষের রক্ত থেকে প্রোটিন সংগ্রহ করে এরা ডিম তৈরি করে। শিকার শনাক্ত করতে স্ত্রী মশারা এদের অ্যান্টেনা এবং পালপস ব্যবহার করে। অ্যান্টেনার মধ্যবর্তী অঙ্গগুলো ব্যবহার করে কার্বন ডাই অক্সাইড ও গন্ধ শনাক্ত করার জন্য। যাদের বিপাকীয় হার বেশি এবং যারা বেশি কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গত করে। গর্ভবতী, ব্যায়াম করা ব্যক্তি বা মদ্যপায়ীর বিপাকীয় হার বেশি এবং এরা বেশি কার্বন ডাই অক্স্রাইড নির্গত করে বলে মশারা বেশি আকৃষ্ট হয়।

 

মশারা কোনো নির্ষ্টি রক্তের গ্রুপ পছন্দ করে কি না এই প্রশ্নটি বিতর্কিত। একটি তত্ত্ব অনুসারে, রক্তের গ্রুপও মশার পছন্দ নির্ধারণে সাহায্য করতে পারে। যদি তাই হয়, তাহলে মশারা রক্তের কোন গ্রুপ পছন্দ করে?

 

২০১৯ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে ডেঙ্গু ভাইরাসের প্রধান বাহক এডিস মশা অন্যান্য রক্তের গ্রুপের তুলনায় ‘ও’ পজেটিভ রক্তের গ্রুপের লোকদের বেশি পছন্দ করে।

 

তবে আরেকটি গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, রক্তের গ্রুপ একজন ব্যক্তিকে মশার কাছে বেশি বা কম আকর্ষণীয় করে তোলে কি না তা মূল্যায়ন করে পরীক্ষামূলক এবং পরীক্ষাগারের তথ্য অনেক জল্পনা-কল্পনাকে তরান্বিত করেছে।

 

তবে বিজ্ঞানে এটি পরস্পরবিরোধী। গবেষকরা বলছেন, মশার রক্তের গ্রুপের চেয়ে ত্বকের গন্ধ এবং মাইক্রোবায়োটার সাথে বেশি সম্পর্কিত।

 

যদি আপনার মশা দ্বারা আকর্ষিত হওয়ার দুর্ভাগ্য হয়, তবে এটি কেবল আপনার জেনেটিক মেকআপের ওপর নির্ভর করতে পারে।

 

প্লস জার্নালে প্রকাশিত ২০১৫ সালে যৌথভাবে একটি গবেষণায় দেখা গেছে, উচ্চতা ও ওজন জেনেটিক্যালি যে স্তরে জিনগতভাবে সংযুক্ত বলে বিবেচিত হয় তার সাথে মিল রেখে ‘ডিএনএ’ মশার আকর্ষণের প্রায় ৬৭ শতাংশ কারণ হতে পারে। মশারা যে ধরনেরই হোক না কেন, উপরোক্ত উপদানগুলোর অনিঃসরণকারীর চেয়ে নিঃসকারীর প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়।

 

রক্তের গ্রুপ

আগেই বলেছি, মশা আমাদের রক্ত থেকে প্রোটিন সংগ্রহ করার জন্য কামড়ায়। গবেষণায় দেখা গেছে, এরা নির্দিষ্ট রক্তের গ্রুপগুলোকে অন্যগুলোর তুলনায় বেশি ক্ষুধা উদ্রেককারী হিসেবে মনে করে।

 

একটি গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে, মশারা রক্তের ‘এ’ টাইপ গ্রুপের লোকেদের তুলনায় ‘ও’ রক্তের গ্রুপের লোকদের প্রায় দ্বিগুণ বেশি আক্রমণ করে। টাইপ ‘বি’ রক্তের গ্রুপের লোকেরা এই ধরনের আক্রমনের মাঝখানে কোথাও পড়ে যায়। এছাড়াও অন্যান্য জিনের ওপর ভিত্তি করে, প্রায় ৮৫ শতাংশ মানুষ তাদের ত্বকের মাধ্যমে একটি রাসায়নিক সংকেত নি:সরণ করে যা নির্শে করে যে তাদের রক্তের গ্রুপ কোনটি। গ্রুপ যে ধরনেরই হোক অনি:সরণকারীদের তুলনায় নি:সকারীদের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়।

 

কার্বন ডাই অক্সাইড

মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে নির্গত কার্বন ডাই অক্সাইডের গন্ধ গ্রহণ করে মশারা তদের লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ করে। তারা এটি করার জন্য ম্যাক্সিলারি পালপ নামক একটি অঙ্গ ব্যবহার করে এবং ১৬৪ ফুট দূর থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড শনাক্ত করতে পারে। ফলস্বরূপ, যারা বেশি গ্যাস ত্যাগ করে সাধারণত বিশাল দেহী মানুষ মশাদের বেশি আকৃষ্ট করে। শিশুরা প্রাপ্ত বয়স্কদের তুলনায় মশার কামড়ে কিছুটা কম ঘন ঘন আক্রান্ত হয়।

 

ব্যায়াম এবং বিপাক

কার্বন ডাই অক্সাইডের পাশাপাশি, মশারা এদের সম্ভাব্য শিকারের ঘামের মাধ্যমে নির্গত ল্যাকটিক অ্যাসিড, ইউরিক অ্যাসিড, অ্যামোনিয়া এবং অন্যান্য পদার্থের গন্ধের মাধ্যমে খুব কাছ থেকে শিকার খুঁজে পায় এবং শরীরে উচ্চ তাপমাত্রার লোকেদের প্রতিও আকৃষ্ট হয়। কঠোর ব্যায়াম শরীরে ল্যাকটিক অ্যাসিড এবং তাপ জমা করে বলে মশাসহ অন্যান্য পোকামাকড় ওই শরীরটাকে এই বৈশিষ্ট্য নেই এমন শরীর থেকে আলাদা করে তোলে। জিনগত বৈশিষ্ট্য প্রতিটি ব্যক্তির শরীরে প্রাকৃতিকভাবে নির্গত ইউরিক অ্যাসিড এবং অন্যান্য পদার্থের পরিমাণকে প্রভাবিত করে, ফলে কিছু লোক মশাদের দ্বারা অন্যদের তুলনায় আকৃষ্ট হয়।

 

ত্বকের ব্যাকটেরিয়া

আরো গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষের ত্বকে প্রাকৃতিকভাবে বসবাসকারী নির্দিষ্ট ধরনের এবং পরিমাণের ব্যাকটেরিয়ার প্রতি মশারা প্রভাবিত হয়। ২০১১ সালের এক গবেষণায় বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, কয়েক ধরণের ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি মশার কাছে ত্বককে আরো আকর্ষণীয় করে তোলে। আশ্চর্যজনকভাবে প্রচুর ব্যাকটেরিয়া থাকা সত্ত্বেও অন্যান্য কিছু প্রজাতির ত্বককে মশার কাছে কম আকর্ষণীয় করে তোলে। এই কারণেই আমাদের গোড়ালি এবং পায়ে মশাদের কামড়ানোর প্রবণতা বেশি থাকে।

 

গর্ভাবস্থা

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, গর্ভবতী মায়েরা অন্যদের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণেরও বেশি মশার কামড়ের শিকার হন। গর্ভবতীরা প্রায় ২১ শতাংশ বেশি কার্বন ডাই অক্সাইড ত্যাগ করে এবং গড়ে অন্যদের তুলনায় তাদের শরীর প্রায় ১ দশমিক ২৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট উষ্ণ থাকে।

 

পোশাকের রঙ্গ

এটা অযৌক্তিক মনে হতে পারে যে মশারা মানুষের অবস্থান (ঘ্রাণসহ) শনাক্ত করতে পারে রংয়ের মাধ্যমে। স্পষ্টভাবে দেখা যাওয়া রঙ্গ (কালো, গাঢ় নীল বা লাল) পরলে যে কাউকে খুঁজে পাওয়া সহজ হতে পারে বলে গবেষনায় দেখেছেন ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক মেডিক্যাল কীটতত্ত্ববিদ জোনাথন ডে।

 

জেনেটিক

সামগ্রিকভাবে মশার প্রতি মানুষের আকর্ষণের ৮৫ শতাংশ পরিবর্তনশীলতার জন্য অন্তর্নিহিত জেনেটিক কারণগুলো দায়ী বলে অনুমান করা হয় সেটা রক্তের ধরণ, বিপাক বা অন্যান্য কারণের মাধ্যমে প্রকাশিত হোক না কেন। দুর্ভাগ্যবশত, আমাদের কাছে (এখনো) এই জিনগুলো পরিবর্তন করার কোনো উপায় নেই, কিন্তু আমাদের নিজেদেরকে মশার হাত থেকে রক্ষা করার অনেক পদ্ধতি আছে।

 

প্রাকৃতিক প্রতিরোধক

কিছু সংখ্যক মানুষ খুব কমই মশাদের দ্বারা আকৃষ্ট হয় অর্থাৎ কাছে পেলেও মশারা এসব মানুষ কামড়ায় না। এটা কেন হয় তা গবেষকরা খতিয়ে খেতে শুরু করেছেন। পরবর্তী প্রজন্মের পোকামাকড় প্রতিরোধক তৈরির আশায় গবেষকরা এটা নিয়ে গবেষণা শুরু করে দিয়েছেন। কিছু মানুষকে মশারা কেন কামড়ায় না, এর কারণটা বের করতে পারলে তা দিয়ে পরবর্তীতে মশা প্রতিরোধক ওষুধ অথবা প্রাকৃতিক প্রতিরোধক আবিষ্কার করা যাবে এই আশা নিয়ে তারা গবেষণা করছেন।

 

যুক্তরাজ্যের রথামস্টেড রিসার্চ ল্যাবের বিজ্ঞানীরা ক্রোমাটোগ্রাফি ব্যবহার করে নির্দিষ্ট রাসায়নিক পদার্থগুলোকে আলাদা করে দেখেছেন যে প্রাকৃতিক প্রতিরোধকগুলো এমন কিছু পদার্থ নির্গত করে যা মশার কাছে আকর্ষণীয় বলে মনে হয় না।

 

লেখক : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, কীটতত্ত্ব বিভাগ, জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম), মহাখালী, ঢাকা।