রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর স্নেহধন্য ১০ শিশু

মহানবী (সা.) শিশুদের প্রতি অত্যন্ত স্নেহপরায়ণ ছিলেন। তিনি তাঁর পরিবার ও পরিবারের বাইরে সব শিশুকে স্নেহ করতেন। আনাস বিন মালিক (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর চেয়ে শিশুদের প্রতি বেশি দয়াশীল আর কাউকে আমি দেখিনি।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৫৯২০)

উম্মতকেও তিনি শিশুর প্রতি স্নেহশীল হওয়ার শিক্ষা দিয়েছেন।

তিনি বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমাদের ছোটদের স্নেহ করে না এবং আমাদের বড়দের সম্মান বোঝে না, সে আমাদের দলভুক্ত নয়।’
(সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৪৪৫০)

এভাবে অসংখ্য হাদিসে শিশুর প্রতি মহানবী (সা.)-এর স্নেহ ও মমতার চিত্র ফুটে উঠেছে, যা উম্মতের জন্য শিক্ষণীয় ও অনুসরণীয়।

নবীজি (সা.)-এর স্নেহধন্য ১০ শিশু

নবীযুগের ১০ শিশুর প্রতি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর স্নেহ ও মমতার চিত্র তুলে ধরা হলো—

১. পুত্র ইবরাহিম : নবীজি (সা.)-এর শিশুপুত্র ইবরাহিমের প্রতি তাঁর স্নেহ ও মমতা সম্পর্কে আনাস বিন মালিক (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ছেলে ইবরাহিম মদিনার গ্রামাঞ্চলে দুধ পান করতেন। রাসুল (সা.) তাঁকে দেখতে সেখানে যেতেন।

আমরাও তাঁর সঙ্গে যেতাম। তিনি ইবরাহিমের দুধ মায়ের ঘরে ঢুকতেন আর সেখানে ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন থাকত। কেননা, তাঁর দুধপিতা কর্মকার (কামার) ছিল। তিনি ছেলেকে কোলে তুলে চুমু খেতেন।
পরে তিনি প্রত্যাবর্তন করতেন। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৫৯২০)

 

২. হাসান বিন আলী (রা.) : ফাতেমা (রা.)-এর ছেলে হাসান বিন আলী (রা.) ছিলেন নবীজি (সা.)-এর অত্যন্ত প্রিয়। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, এক দিন নবী (সা.) বনু কায়নুকা বাজারে এলেন, (সেখান থেকে ফিরে এসে) ফাতেমা (রা.)-এর ঘরের আঙিনায় বসে পড়লেন। তারপর বললেন, এখানে খোকা (হাসান) আছে কি?

এখানে খোকা আছে কি? ফাতেমা (রা.) তাঁকে কিছুক্ষণ দেরি করালেন। আমার ধারণা হলো তিনি তাঁকে পুতির মালা সোনা-রুপা ছাড়া যা বাচ্চাদের পরানো হতো, পরাচ্ছিলেন।

তারপর তিনি দৌড়ে এসে তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন এবং চুমু খেলেন। তখন তিনি বললেন, হে আল্লাহ! তুমি তাকেও (হাসানকে) মহব্বত করো এবং তাকে যে ভালোবাসবে তাকেও মহব্বত কোরো। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২১২২)

 

৩. হুসাইন বিন আলী (রা.) : ফাতেমা (রা.)-এর অপর পুত্র হুসাইন বিন আলী (রা.)-ও নবীজি (সা.)-এর স্নেহধন্য ছিলেন। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) একবার হাসান বিন আলী (রা.)-কে চুম্বন করেন। সে সময় তাঁর কাছে আকরা বিন হাবিস তামিমি (রা.) বসে ছিলেন। আকরা বিন হাবিস (রা.) বললেন, ‘আমার ১০টি পুত্র আছে, আমি তাদের কাউকেই কোনো দিন চুম্বন করিনি। রাসুলুল্লাহ (সা.) তার দিকে তাকিয়ে বললেন, যে দয়া করে না, সে দয়া পায় না।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫৯৯৭)

৪. ইবরাহিম বিন আবু মুসা (রা.) : সাহাবায়ে কিরাম (রা.)-এর অভ্যাস ছিল সন্তান হলে তাঁরা নবীজি (সা.)-এর কাছে নিয়ে আসতেন। নবীজি (সা.) শিশুকে চুমু খেতেন, তাহনিক করতেন (মুখে খাবার চিবিয়ে খাওয়ানো), শিশুর জন্য বরকতের দোয়া করতেন, কখনো কখনো নাম রাখতেন। এমনই সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন আবু মুসা আশআরি (রা.)-এর বড় ছেলে ইবরাহিম। তিনি বলেন, ‘আমার একটি পুত্রসন্তান জন্মালে আমি তাকে নিয়ে নবী (সা.)-এর কাছে গেলাম। তিনি তার নাম রাখলেন ইবরাহিম। তারপর খেজুর চিবিয়ে তার মুখে দিলেন এবং তার জন্য বরকতের দোয়া করেন। অতঃপর তাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিলেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫৪৬৭)

৫. আবদুল্লাহ বিন জোবায়ের (রা.) : তাঁর মা আসমা বিনতে আবু বকর (রা.) বলেন, ‘গর্ভকাল পূর্ণ হওয়া অবস্থায় আমি মক্কা থেকে মদিনায় এলাম এবং কুবায় অবতরণ করলাম। কুবায়ই আমি তাকে প্রসব করি। তারপর তাকে নিয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এসে তাকে তাঁর কোলে রাখলাম। তিনি একটি খেজুর আনতে বললেন। তা চিবিয়ে তিনি তার মুখে দিলেন। রাসুল (সা.)-এর এই লালাই সর্বপ্রথম তার পেটে প্রবেশ করেছিল। তারপর তিনি খেজুর চিবিয়ে তাহনিক করলেন এবং তার জন্য বরকতের দোয়া করলেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস ৫৪৬৯)

৬. উম্মু খালিদ (রা.) : তিনি ছিলেন খালিদ বিন সাঈদ বিন আস (রা.)-এর কন্যা। তাঁর মা-বাবা উভয়ে হাবশায় হিজরত করেন এবং সেখানেই তাঁর জন্ম হয়েছিল। মদিনায় আসার পর নবীজি (সা.) তাঁকে নতুন কাপড় উপহার দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, একবার রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে কিছু কাপড় নিয়ে আসা হয়। তার মধ্যে কিছু কালো নকশিদার ছোট চাদর ছিল। তিনি বললেন, আমরা এগুলো পরব, তোমাদের মত কী? উপস্থিত সবাই চুপ থাকল। তারপর তিনি বললেন, উম্মু খালিদকে আমার কাছে নিয়ে এসো। তাকে বহন করে আনা হলো। রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজের হাতে একটি চাদর নিলেন এবং তাঁকে পরিয়ে দিলেন। তিনি বললেন, এটি তুমি পুরাতন কোরো এবং ছিঁড়ে ফেলো (তুমি বহুদিন বাঁচো)। নবীজি (সা.) বললেন, উম্মে খালিদ! এটি কত সুন্দর! (সহিহ বুখরি, হাদিস : ৫৮২৩)

৭. উমামা বিনতে আবুল আস (রা.) : তিনি ছিলেন মহানবী (সা.)-এর নাতনি। তাঁর প্রতিও নবীজি (সা.) অত্যন্ত স্নেহশীল। আবু কাতাদা আনসারি (রা.) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসুল (সা.) তাঁর মেয়ে জয়নবের গর্ভজাত ও আবুল আস (রা.)-এর ঔরসজাত কন্যা উমামা (রা.)-কে কাঁধে নিয়ে নামাজ আদায় করতেন। তিনি যখন সিজদায় যেতেন তখন তাঁকে রেখে দিতেন আর যখন দাঁড়াতেন তখন তাঁকে তুলে নিতেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫১৬)

৮. ইহুদি বালক : আনাস বিন মালিক (রা.) বলেন, এক ইহুদি বালক নবী (সা.)-এর সেবা করত, সে একবার অসুস্থ হয়ে পড়লে নবী (সা.) তাকে দেখতে যান। তিনি তার মাথার কাছে বসলেন এবং বললেন, তুমি ইসলাম গ্রহণ করো, সে তখন তার পিতার দিকে তাকাল—সে তার নিকটেই ছিল, পিতা তাকে বলল, আবুল কাসেমের কথা মেনে নাও, তখন সে ইসলাম গ্রহণ করল। নবী (সা.) সেখান থেকে বের হওয়ার সময় বললেন, সব প্রশংসা সেই আল্লাহর, যিনি তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিলেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৩৫৬)

৯. আবু উমায়ের (রা.) : বিখ্যাত সাহাবি আনাস (রা.)-এর ভাই আবু উমায়ের (রা.)। নবীজি (সা.) তাঁদের দুই ভাইয়ের প্রতি স্নেহপরায়ণ ছিলেন। আনাস বিন মালিক (রা.) বলেন, নবী (সা.) আমাদের সঙ্গে আন্তরিকভাবে মেলামেশা করতেন, এমনকি তিনি আমার এক ছোট ভাইকে জিজ্ঞাসা করতেন, হে আবু উমায়ের! কেমন আছে তোমার নুগায়ের? (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬১২৯)

১০. উসামা বিন জায়েদ (রা.) : আবদুল্লাহ বিন ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) একটি সেনাদল প্রেরণ করেন এবং উসামা বিন জায়েদ (রা.)-কে তাদের সেনাপতি নিযুক্ত করেন। তখন কোনো কোনো সাহাবি (সম্ভবত বয়স কম হওয়ায়) তাঁর নেতৃত্বের সমালোচনা করেন। এতে রাসুলুল্লাহ (সা.) দাঁড়ালেন এবং বললেন, ‘তোমরা আজ তার নেতৃত্বের সমালোচনা করছ, এভাবে তোমরা তার পিতা জায়েদের নেতৃত্বের সমালোচনা করতে। আল্লাহর কসম! সে (জায়েদ) ছিল নেতৃত্বের জন্য যোগ্য ব্যক্তি এবং আর সে আমার কাছে লোকদের মধ্যে প্রিয়তম ব্যক্তি। তার এ (উসামা) লোকদের মধ্যে আমার কাছে প্রিয়তম ব্যক্তি।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৪৪৬৯)

আল্লাহ রাসুলুল্লাহ (সা.), তাঁর পরিবার ও সাহাবিদের ওপর শান্তি বর্ষণ করুন। আমিন।