ফের ভোজ্যতেলের দাম আরও বৃদ্ধি, নেপথ্যে কারা
ভোল পালটে ভোজ্যতেলের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে আওয়ামী আমলের পুরোনো সিন্ডিকেট। অন্তর্বর্তী সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে নভেম্বর মাস থেকে চক্রটি নানাভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ববাজারে দাম কমলেও স্থানীয় ভোক্তাদের জিম্মি করে দেশের বাজারে দাম বাড়ানোর কৌশল পুরোনো।
সর্বশেষ লিটারে ১৪ টাকা বাড়ানোর পরও সেই সিন্ডিকেট আরও ৭ টাকা বাড়ানোর পাঁয়তারা করছে। কয়েকটি কোম্পানি মিলে এই সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে তাদের বক্তব্যও পুরোনো। আগের মতোই এখনো অন্যের কাঁধে দায় চাপাচ্ছে। ডলারের দাম বৃদ্ধি, ব্যাংক খাতের অস্থিরতাসহ নানা কারণে তারা আমদানিতে সুফল পাচ্ছে না। ফলে বিশ্ববাজারে দাম কমলেও দেশে এর সুফল মিলছে না।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন যুগান্তরকে বলেন, বিশ্ববাজারে ধারাবাহিকভাবে ভোজ্যতেলের দাম কমছে। কিন্তু দেশের বাজারে ধারাবাহিকভাবে দাম বাড়ানো হচ্ছে। এই সময় মূল্য বাড়ানো অযৌক্তিক।
তিনি জানান, দেশের ৪ থেকে ৫টি কোম্পানি তেলের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা গত সরকারের আমলেই চিহ্নিত। নতুন সরকারের আমলে তারা লেবাস বদলেছে। সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে ইচ্ছামতো ভোজ্যতেলের মূল্য নির্ধারণ করে ক্রেতাকে জিম্মি করছে। এদের শাস্তির আওতায় না আনায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে তিনি যোগ করেন।
গত বছর নভেম্বরের শুরুতে অস্থিরতা দেখা দেয় ভোজ্যতেলের বাজারে। ওই সময় বোতলজাত সয়াবিন তেল দাম বেড়ে প্রতিলিটার ১৭৫ থেকে ১৮০ ও খোলা তেল বিক্রি হয় ১৮৫ টাকায়। প্রথম দফায় ১৭ অক্টোবর ও দ্বিতীয় দফায় ১৯ নভেম্বর শুল্ককর কমিয়ে তা নামানো হয় ৫ শতাংশে। এতে বাজারে সামান্য কমে ভোজ্যতেলের দাম। তবে নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে এসে বাজার থেকে উধাও হতে শুরু হয় ১ ও ২ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেল। ব্যবসায়ীদের দাবি অনুযায়ী ৯ ডিসেম্বর লিটারে ৮ টাকা বাড়ানো হয়। তবুও সে সময় সরবরাহ সংকট কাটেনি। এরপর ১৬ ডিসেম্বর ভোজ্যতেলের দাম সহনীয় রাখতে ২০২৫ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত আমদানিতে শুল্ক, রেগুলেটরি ডিউটি ও অগ্রিম আয়কর শতভাগ অব্যাহতি দেয় সরকার। পাশাপাশি ভ্যাট ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়। তারপরও অস্থিরতা কাটে না। রোজা ও ঈদে সরবরাহ ঠিক থাকলেও সরকারের নীতি সহায়তার মেয়াদ শেষে ১৪ এপ্রিল দ্বিতীয় ধাপে লিটারে ফের ১৪ টাকা মূল্য বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়। এই বাড়তি মূল্য বাজারে কার্যকর হয়।
এদিকে নতুন দর অনুযায়ী প্রতিলিটার খোলা সয়াবিন তেলের দাম নির্ধারণ করা হয় ১৬৯ টাকা। পাশাপাশি বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ধরা হয় ১৮৯ টাকা। তবে রাজধানীর কাওরানবাজার, জিনজিরা কাঁচাবাজার, নয়াবাজার, মালিবাগ কাঁচাবাজার ও রামপুরা বাজার ঘুরে এই দামেও সয়াবিন তেল বিক্রি করতে দেখা যায়নি। রোববার খুচরা বাজারে প্রতিলিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল বিক্রি হয় ১৯০ ও খোলা সয়াবিন তেল প্রতিলিটার ১৮০ টাকায় বিক্রি করতে দেখা গেছে। সেক্ষেত্রে বোতলজাত সয়াবিন তেলে লিটারে ১ টাকা বেশি বিক্রি হলেও খোলা সয়াবিন তেলে বিক্রেতারা ১১ টাকা বেশি দরে বিক্রি করছে।
জিনজিরা কাঁচাবাজারের মুদি বিক্রেতা মো. সাগর বলেন, রোজার আগ থেকেই কোম্পানিগুলো লিটারে ২০ টাকার ওপরে দাম বাড়াতে চেয়েছে। কিন্তু সরকার বাড়ায়নি। সে কারণে কোম্পানিগুলো বাজারে তেলের সরবরাহ কমিয়ে তেল প্রায় উধাও করেছিল। আমদানিতে শুল্ক ছাড় দেওয়ায় রমজান মাসের মাঝামাঝি ও ঈদের সময় সরবরাহ বেড়েছে। তবে শুল্ক ছাড়ের মেয়াদ শেষ হওয়ায় লিটারে ফের ১৪ টাকা বাড়িয়েছে দাম। তবে কোম্পানিগুলোর ডিলাররা বলাবলি করছে, বাজারে ফের তেলের সরবরাহ কমতে পারে। কারণ কোম্পানিগুলো লিটারে ২০-২১ টাকা বাড়াতে চেয়েছে। কিন্তু সরকার লিটারে ১৪ টাকা বাড়িয়েছে। ফলে আরও ৭ টাকা বাড়ানোর পাঁয়তারা করছে।
রোববার বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন সূত্র জানায়, সরকারকে বেকায়দায় ফেলার মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি। সরকারের সব নিয়ম মেনে কোম্পানিগুলো ব্যবসা করে। তবে এখন বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের বাজার কিছুটা স্থিতিশীল। কয়েক মাস আগে দাম কিছুটা কমলেও এখন আবার আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিটন সয়াবিন তেল ১১০০ ডলারে বিক্রি হচ্ছে। পাশাপাশি ডলারের দাম বৃদ্ধি ও ব্যাংক খাতে অস্থিরতা চলছে।
যে কারণে আমদানি করতে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। ফলে বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমলেও দেশে সুফল পাচ্ছে না। বরং ভোজ্যতেল কোম্পানিগুলো লোকসান গুনছে। সরকার আমদানিতে শুল্কছাড় ও নীতি সহায়তার মেয়াদ শেষ হওয়ায় ভ্যাট ও ট্যাক্স আগের মতো দিতে হচ্ছে। এ কারণে আমদানি করতে দাম বেড়ে যাচ্ছে। হিসাব করলে লিটারে ২১ টাকার বেশি বাড়ানোর কথা। কিন্তু সরকার সয়াবিন তেলের দাম বাড়িয়েছে লিটারে ১৪ টাকা।